ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম সম্পর্কে জানুন
ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম সম্পর্কে জানা প্রত্যেক মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কোরবানির মাধ্যমে ইব্রাহিম (আঃ) এর আনুগত্য ও ত্যাগের গল্পের স্মরণ করায়। এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালার প্রতি কতটা আনুগত্য হওয়া উচিত।
কোরবানি শুধু মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে নয় বরং ধনী ও গরিবদের মাঝে সুসম্পর্ক ও ভেদাভেদ দূর করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে কোরবানি। আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে কোরবানি। এখন আমরা কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
সূচিপত্র ঃ ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম
- ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম
- ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি দেওয়ার গুরুত্ব
- সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি দেওয়ার গুরুত্ব
- পশু কোরবানি করার শরিয়ত সম্পূর্ণ নিয়ম
- ইসলামে কোরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য
- কোরবানির মাংস বণ্টন করার সঠিক পদ্ধতি
- কাদের উপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব
- হজে যাওয়া ব্যক্তিরা কীভাবে কোরবানি দিয়ে থাকেন
- ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন ও উত্তর
- শেষ কথা ঃ ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম
ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম
ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। কোরবানি হচ্ছে ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তায়ালার আদেশে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) কে কোরবানি করার যে পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তা আজও সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে চরম আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি হিসেবে রয়ে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা শরিয়াত সম্পূর্ণ পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। বলা হয়ে থাকে যে আল্লাহ তায়ালা কোরবানি কৃত পশুর রক্ত মাটিতে গড়ানোর আগেই মানুষের নিয়তের উপর নির্ভর করে কোরবানি কবুল করে নেন। তাই কোরবানি করার মূল উদ্দেশ্য মাংস খাওয়া নয় বরং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানি করার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা। একজন সামর্থ্যবান ব্যক্তি অর্থাৎ যে ব্যক্তির নিসাব পরিমাণ অর্থ থাকবে সেই ব্যক্তির উপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব হয়ে পড়ে। নিসাব পরিমাণ অর্থ বলতে ৭.৫ তোলা স্বর্ণ, ৫২.৫ তোলা রূপা অথবা সমপরিমাণ অর্থ থাকবে তার উপর কোরবানি করা ওয়াজিব। ওয়াজিব বলতে ফরজ এর নিচের ধাপকে বোঝায়। তাই কোরবানি বলতে শুধু মাংস খাওয়ার উৎসব নয় বরং কোরবানি হচ্ছে আত্মত্যাগ, কৃতজ্ঞতা, সহমর্মিতা ও আখিরাতের প্রতি সচেতন হওয়ার একটি মাধ্যম। এখন আমরা কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি দেওয়ার গুরুত্ব
কোরবানি হচ্ছে ইমান ও আত্মত্যাগ এর পরীক্ষা। তাই ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি দেওয়ার গুরুত্ব অনেক। যখন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন আল্লাহর আদেশে তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) কে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হন তখন সেটা ছিল ইমানের সর্বোচ্চ প্রমাণ। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য কোনো কিছুই বড় নয়। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য সব সময় সকল কিছুই উৎসর্গ করার মত ইমান রাখতে হবে। এটিই মূলত কোরবানি থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর মহান আত্মত্যাগের শিক্ষা নিয়েই কোরবানি আজও মুসলিমদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি করার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করা। যে ব্যক্তি খাটি নিয়ত নিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করে তার জন্য রয়েছে অনেক সওয়াব। কোরবানির ফলে বান্দা যেমন আখিরাতে মুক্তি পায় ঠিক তেমনি দুনিয়ার জীবনেও আল্লাহ তায়ালা রহমত দান করেন। এ বিষয়ে কোরআন থেকে ও হাদিস থেকে কিছু উদাহরণ দেখলে আমরা আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবো কেন আমাদের কোরবানি দেওয়া উচিত।
- আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ আল্লাহর কাছে পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। - (সূরা হজ্বঃ আয়াত ৩৭)
- আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি যাতে তারা আল্লাহর প্রদত্ত চতুষ্পদ পশুর ওপর আল্লাহর নাম স্মরণ করে কোরবানি দেয়। - (সূরা হজ্বঃ আয়াত ৩৪)
- তিরমিজি শরীফ থেকে বর্ণিতঃ কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং মন থেকে কোরবানি করো। - (তিরমিজি, হাদীসঃ ১৪৯৩)
- আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরবানি করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। - (ইবনে মাজাহঃ ৩১২৩)
- সহীহ বুখারি থেকে বর্ণিতঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, নবী করিম (সাঃ) ১০ বছর মদিনায় ছিলেন এবং প্রতি বছর কোরবানি করতেন। - (সহীহ বুখারি)
আল-কুরআন থেকে ও কিছু হাদিস শরীফ এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি করার কথা কতটা গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে। এর সারাংশ হিসেবে বলতে পারি কোরবানি শুধু পশু জবাহ করে মাংস খাওয়ার উৎসব নয় বরং এটি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার একটি অন্যতম মাধ্যম।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি দেওয়ার গুরুত্ব
কোরবানির মাধ্যমে ধনী ও গরিবদের মাঝে ভেদাভেদ দূর হয় তাই সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি দেওয়ার রয়েছে অনেক গুরুত্ব। কেননা কোরবানি শুধু একটি ইবাদত নয় বরং এর মাধ্যমে সমাজে সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের অনন্য বন্ধন তৈরি করে। কোন সমাজে শান্তি ও পারস্পরিক সহযোগিতা তখনই সম্ভব যখন ঐ সমাজের সকল মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর হয়। মূলত কোরবানির মাধ্যমে সমাজে বসবাসরত ধনী ও গরিবদের মাঝে বৈষম্য দূর করে ভাত্রিত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে।
- পবিত্র আল - কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ তোমরা তা থেকে খাও এবং আহার করাও সে সকল অভাবগ্রস্তকে যারা প্রার্থনা করে এবং যারা প্রার্থনা করে না - (সূরা আল - হাজ্জ, আয়াত ৩৬)
- রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ তোমরা খাও, জমা রাখো এবং সদকা করো। - (সহীহ মুসলিমঃ ১৯৭১)
- রাসূল (সাঃ) আরও বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোরবানি করল কিন্তু গরীব - দুঃখীদের কিছুই দিল না, তার কোরবানি কবুল হবে না। - (তাবারানী, আওসাতঃ হাদীস ৫৮৭৬)
- ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করো। একভাগ আত্মীয়দের জন্য, একভাগ দরিদ্রদের জন্য, আর একভাগ নিজের পরিবারের জন্য। - (বায়হাকি, শুআবুল ঈমানঃ ৩৫৮৫)
উপরের পবিত্র আল - কোরআন ও কিছু হাদিস থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে কোরবানির মাংস তিনভাগে ভাগ করার নির্দেশ খুব কঠোর ভাবে করা হয়েছে। তিন ভাগে কোরবানির মাংস বণ্টনের ফলে যারা সমাজে গরীব বা কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই তারাও কোরবানির আনন্দ উপভোগ করতে পারে। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা কোরআন এর সূরা আল - হাজ্জ এর ৩৬ নং আয়াতে স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছেন যে কোরবানির মাংস নিজে খেতে ও অভাবগ্রস্তকে খাওয়াতে। এরফলে ধনি ও গরিবদের মাঝে ভেদাভেদ কমে ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
পশু কোরবানি করার শরিয়ত সম্পূর্ণ নিয়ম
কোরবানি বলতে শুধু মাত্র পশু কোরবানি করাকে বোঝায় না বরং পশু কোরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু দিক লক্ষ্য রাখতে হয়। আপনি যদি পশু কোরবানি করার শরিয়ত সম্পূর্ণ নিয়ম না মেনে পশু কোরবানি করেন তাহলে সেই পশু আল্লাহ তায়ালা কবুল নাও করতে পারেন। তাই পশু কোরবানি করার পূর্বে কিছু শরিয়ত সম্পূর্ণ নিয়ম জেনে রাখা ভালো।
পশু কোরবানি করার আগে সবার আগে যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সেটি হচ্ছে পশু ক্রয় করার পূর্বে অবশ্যই পশুটি কোরবানির জন্য জায়েজ কিনা সেটি যাচাই করে নিতে হবে। সাধারণ কোরবানি জন্য গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উট, দুম্বা ইত্যাদি জাতীয় পশু জায়েজ। এরপর যে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে সেটি হচ্ছে উক্ত পশুটির বয়স শরিয়ত সম্পূর্ণ আছে কিনা। সাধারণত কোরবানির জন্য গরু ও মহিষের বয়স দুই বছর, উটের বয়স ৫ বছর, ছাগল বা ভেড়া এক বছর হতে হবে তাহলে সেই পশুটি কোরবানির জন্য যোগ্য হবে। বয়স নির্ধারনের জন্য পশুর দাঁত দেখে বয়স নির্ধারণ করতে পারেন।
আল্লাহ তায়ালার কাছে কোরবানি কবুল হওয়ার মূল শর্ত হচ্ছে নিয়ত। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দেওয়ার নিয়ত গ্রহণ করতে হবে। কোরবানির নিয়ত মুখে না বলেও অন্তর থেকে করা যায়। কোরবানির পূর্বে মনে মনে নিয়ত করার জন্য বলতে পারেন - আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করছি। অথবা আপনি মুখে বলেও কোরবানির জন্য নিয়ত করতে পারেন। মুখে বলে নিয়ত করা সুন্নত। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, হা-যা মিন্নী - এই কথাটি বলে নিয়ত করে নিতে পারেন।
এরপর কোরবানি করার সময়সীমা হচ্ছে ১০ জিলহজ ঈদের নামাজ পড়ে আসার পর থেকে ১১ ও ১২ জিলহজ পর্যন্ত। একটি বিষয় যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে ঈদের নামাজের পূর্বে কোরবানি করলে সেটি বৈধ হবে না তাই কোরবানি অবশ্যই ঈদের নামাজ পড়ে আসার পর করতে হবে। এরপর পশুকে কমল ভাবে কেবলা মুখী করে শুইয়ে ধারানো ছুরি দিয়ে পশু কোরবানি করতে হবে। এরপর পশু কোরবানি শেষে উক্ত মাংস তিন ভাগে সমানভাবে ভাগ করে এক ভাগ নিজে রাখতে হবে এবং বাঁকি দুই ভাগ আত্নীয় সজন ও গরীব ও অসহায়দের জন্য রাখতে হবে।
ইসলামে কোরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ছিলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের একান্ত প্রিয় একজন নবী। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) দীর্ঘদিন ছিলেন সন্তানহীন। আল্লাহ তায়ালার কাছে অনেক চাওয়ার পর তার শেষ বয়সে তিনি একজন পুত্র সন্তানের পিতা হন। সেই পুত্রটি ছিল মূলত হযরত ইসমাইল (আঃ)। অনেক দিন পর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) একটি স্বপ্নে দেখলেন তিনি তার শিশু পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) কে কোরবানি করছেন। ঠিক একই স্বপ্ন বারবার দেখার পর তিনি নিশ্চিত হলেন এটি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার দেখানো স্বপ্ন। মূলত এটি ছিল আল্লাহ তায়ালার দেওয়া হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ইমান যাচাই করার জন্য এক মহাপরীক্ষা।
এই ঘটনার পর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) কে তার স্বপ্নের ব্যাপারে সকল বিষয় খুলে বলেন। সকল বিষয় খুলে বলার পর হযরত ইসমাইল (আঃ) উত্তরে জানান - হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। - (সূরা আস - সাফফাত, আয়াতঃ ১০২) এরপর আল্লাহ দেখানো স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে যখন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার প্রিয় শিশু পুত্র এর গলার উপর ছুরি চালান ঠিক সেই সময় আল্লায় তায়ালা একটি বিরাট দুম্বা পাঠিয়ে দেন এবং ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে সেই দুম্বাটি কোরবানি হয়ে যায়।
- সূরা আস - সাফফাত, আয়াতঃ ১০৫-১০৭ এ আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি সৎকর্মশীলদেরকে এমনি প্রতিদান দিয়ে থাকি।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর এই ঘটনা থেকে প্রত্যেকে মুসলমানদের চরম শিক্ষা নেওয়া উচিত। আল্লাহ তায়ালার এই পরীক্ষায় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) উর্ত্তিন্য হয়েছিলেন সেই ঘটনাকেই কেন্দ্র করে প্রতিবছর পশু কোরবানি দেওয়া হলেও আমাদেরও উচিত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য যেকোনো কিছু উৎসর্গ করার মত ইমানি শক্তি মজুত রাখা। কোরবানি শুধু পশু কোরবানি করা নয় বরং এটি এক গভীর আত্মত্যাগের প্রতীক। এর মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর প্রতি তার ভালোবাসা, আনুগত্য এবং তাকওয়া প্রকাশ করে থাকে।
কোরবানির মাংস বণ্টন করার সঠিক পদ্ধতি
কোরবানির মাংস বণ্টন নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা বিরাজমান রয়েছে। কোরবানি কৃত পশুর মাংস সমান তিন ভাগে ভাগ করার নির্দেশ রয়েছে। সমান তিন ভাগে ভাগ করার মুক উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে ধনী ও গরিবদের মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনা। এছাড়াও মানুষের উপকারের মানসিকতা তৈরি করার পাশাপাশি দান ও ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কোরবানির মাংস সমান তিন ভাগে ভাগ করার পদ্ধতির কথা আল - কোরআন এবং হাদিস শরীফে স্পষ্টভাবে এসেছে। নিচে কোরআন ও হাদিস থেকে বিস্তারিত বর্ননা করা হলোঃ
১) আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ সুতরাং তা থেকে তোমরা খাও এবং অভাবগ্রস্ত দরিদ্রকে খাওয়াও। - (সূরা হজ্ব, আয়াত ২৮)
২) রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ তোমরা খাও, জমা রাখো এবং সদকা করো। - (সহীহ মুসলিমঃ ১৯৭১)
কাদের উপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব
কোরবানি মুসলিমদের কাছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলেও এটি সকল মুসলিমদের জন্য বাধ্যতা মূলক নয়। কোরবানি দেওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে যদি সেই শর্ত গুলো কোন মুসলিম ব্যক্তির মধ্যে সব গুলো থাকে তাহলেই শুধু মাত্র সেই ব্যক্তির উপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব হবে। অনেকে একটি বিষয় ভুল করেন যে কোরবানি দেওয়া কি ফরজ নাকি সুন্নত। আসলে কোরবানি দেওয়া হচ্ছে ওয়াজিব। ওয়াজিব হচ্ছে ফরজের নিচের ধাপ যা অবশ্যই পালনীয়। এখন আমরা জানবো কি কি বৈশিষ্ট থাকলে একজন মানুষের উপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব হয়ে যায়।
- কোরবানি দেওয়ার জন্য অবশ্যই মুসলিম হতে হবে।
- প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে।
- মানুসিক ভাবে সুস্থ হবে হবে।
- উক্ত এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা হতে হবে।
- নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে।
হজে যাওয়া ব্যক্তিরা কীভাবে কোরবানি দিয়ে থাকেন
হজ হচ্ছে ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে একটি ফরজ ইবাদত। প্রত্যেক সামর্থবান মানুষের জন্য হজে যাওয়া বাধ্যতা মূলক বা ফরজ ইবাদত। হজে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে হাদিয় কোরবানি। হাদিয় কোরবানি কোরবানি সাধারণত হজে যাওয়া কিছু ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব। এই হাদিয় কোরবানি পদ্ধতি সাধারণ কোরবানি দেওয়ার পদ্ধতি থেকে কিছুটা ব্যতিক্রমী। যারা হজে যান এবং তামাত্তু বা কিরান পদ্ধতিতে হজ আদায় করেন সাধারণত তাদের উপর হাদিয় কোরবানি করা ওয়াজিব হয়।
এই হাদিয় কোরবানি করার পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন এই কথা বলার কারণ হচ্ছে বেশির ভাগ হাজি বা হজে যাওয়া ব্যক্তি নিজ কোরবানি না দিয়ে সৌদি সরকার অনুমোদিত ব্যাংক বা এজেন্সির মাধ্যমে হাদিয় নামে একধরনের কুপন অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে থাকেন এবং তার নামেই জিলহজ মাসের ১০ তারিখে মক্কার মিনায় নির্দিষ্ট কোরবানি স্থানে কুপনের মাধ্যমে পশু কোরবানি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাজিদের নিজ হাতে কোরবানি করা বাধ্যতামূলক নয়। এটিই হচ্ছে হজে যাওয়া ব্যক্তিদের কোরবানি করার হাদিয় নিয়ম।
ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্নঃ কোরবানি দেওয়া কি ফরজ নাকি সুন্নত?
উত্তরঃ ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। ওয়াজিব হচ্ছে ফরজের নিচের ধাপ যা অবশ্যই পালনীয়।
প্রশ্নঃ কোরবানি দেওয়া কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তরঃ কোরবানি দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ তোমাদের কোরবানির রক্ত বা মাংস আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। - (সূরা হাজ্জঃ আয়াত ৩৭)
প্রশ্নঃ কাদের উপর কোরবানি করা ওয়াজিব?
উত্তরঃ যে ব্যক্তি মুসলিম, প্রাপ্ত বয়স্ক, মানুসিক ভাবে সুস্থ ও নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে এই ধরনের প্রত্যেক ব্যক্তির উপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব।
প্রশ্নঃ নিসাব পরিমাণ সম্পদ বলতে কি বোঝায়?
উত্তরঃ নিসাব পরিমাণ সম্পদ বলতে ৭.৫ তোলা সোনা বা ৫২.৫ তোলা রূপা অথবা সমপরিমাণ অর্থের মালিক হলে একে নিসাব পরিমাণ সম্পদ বলে।
প্রশ্নঃ কোরবানির মাংস বণ্টনের সুন্নতি পদ্ধতি কি?
উত্তরঃ কোরবানির মাংস তিনভাগে ভাগ করা সুন্নত। যথাঃ
- একভাগ নিজে খাওয়া।
- একভাগ আত্মীয় স্বজনদের জন্য রাখা।
- একভাগ গরিব ও অসহায়দের জন্য রাখা। রেফারেন্স - (মুসনাদে আহমাদ, হাদীসঃ ৫১০৫, সুনান ইবনে মাজাহ, হাদীসঃ ৩১২৫)
প্রশ্নঃ হাদিয় কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কি বলেছেন?
উত্তরঃ হাদিয় কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তামাত্তু হজ আদায় করে, তার জন্য হাদিয় কোরবানি আবশ্যক। - (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৯৬)
প্রশ্নঃ কারো পক্ষে হাদিয় কোরবানি দেওয়া সম্ভব না হলে করণীয় কি?
উত্তরঃ কারো পক্ষে হাদিয় কোরবানি দেওয়া সম্ভব না হলে করণীয় হচ্ছে ১০ দিন রোজা রাখা। তিন দিন হজের সময় এবং বাঁকি ৭ দিন বাড়ি ফিরে রোজা রাখা। রেফারেন্স - (সূরা আল - বাকারা, আয়াত ১৯৬)
প্রশ্নঃ কোরবানির মাংস বা চামড়া বিক্রি করা কি জায়েজ?
উত্তরঃ কোরবানির চামড়া বা মাংস বিক্রি করে টাকা নেওয়া হারাম।
প্রশ্নঃ প্রতিবেশী যদি মুসলিম না হয় তাকে কি কোরবানির মাংস দেওয়া যাবে?
উত্তরঃ প্রতিবেশী অমুসলিম হলেও তাকে মাংস উপহার দেওয়া জায়েজ।
প্রশ্নঃ নারীদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব কি?
উত্তরঃ যদি কোন নারীর নিজের নিসাব পরিমাণ অর্থ থাকে তাহলে সেই নারীর ওপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব হবে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে উক্ত নারীর নিজের নিসাব পরিমাণ অর্থ থাকতে হবে স্বামীর অর্থ নয়।
শেষ কথাঃ ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম
ইসলামিক দৃষ্টিতে কোরবানির গুরুত্ব ও নিয়ম সম্পর্কে আমরা উপরে বিস্তারিত জেনেছি। আমরা আশাবাদী যে আমাদের দেওয়া উপরে তথ্য গুলো থেকে কোরবানি দেওয়ার নিয়ম ও গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে যাবেন। পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয় বর্তমান সমাজে কোরবানি করার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে অনেকেই মাংস খাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। যেটি সম্পূর্ণ কোরবানির নিয়ম উদ্দেশ্যের বিপরীত। কোরবানি দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি, অনুগত্য ও ক্ষমা পার্থনা করা। আমরা এই বিষয় নিয়ে উপরে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আপনি চাইলে উপরে বিস্তারিত পড়ে এ বিষয়ে আরোও অনেক কিছু জানতে পারেন। 250311
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url